।।স্টাফ রিপোর্টার।।
দেশের অন্যতম জনপ্রিয় ভিন্নমাত্রার ব্যান্ড “জলের গান”। যেটির নেতৃত্বে রয়েছেন রাহুল আনন্দ। বিভিন্ন সামাজিক ও সাংস্কৃতিক আন্দোলনে সক্রিয় দেখা যায় রাহুল ও তার দলকে। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে সংহতি জানিয়ে নিজের দলের সদস্যদের নিয়ে রাজধানীর রবীন্দ্র সরোবরে দাঁড়িয়েছিলেন রাহুল আনন্দ।
তবে সরকার পতন ও শিক্ষার্থীদের বিজয়ের পর সেই রাহুল আনন্দের বাড়িতে হামলা, লুটপাট ও অগ্নিসংযোগ করা হয়েছে। ভেঙে তছনছ করার পাশাপাশি পুড়িয়ে ফেলা হয়েছে আলোচিত এই গায়েকর অসংখ্য বাদ্যযন্ত্র।
সোমবার (৫ আগস্ট) রাহুলের বাড়িতে হামলা চালায় দুর্বৃত্তরা।
এদিন প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে শেখ হাসিনার পদত্যাগের পর ধানমন্ডি ৩২ নম্বরে বঙ্গবন্ধু স্মৃতি জাদুঘরে হামলা চালায় দুর্বৃত্তরা। একই সড়কে থাকতেন জলের গান’র রাহুল আনন্দ। ওই সময় তার বাড়িতেও ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করা হয়। এতে পুরো বাড়িটি পুড়ে গেছে বলেও জলের গানের ফেসবুক পেজ থেকে জানানো হয়েছে।
এ বিষয়ে ব্যান্ডের সাবেক সদস্য সাইফুল ইসলাম জার্নাল অনলাইন সংবাদমাধ্যম বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন বলেন, “একটি যন্ত্রও অবশিষ্ট নেই। বছরের পর বছর ধরে রাহুল দা নিজ হাতে ইনস্ট্রুমেন্টগুলো তৈরি করেছিলেন।”
পারিবারিক সূত্রে জানা গেছে রাহুল ও তার পরিবারের সদস্যরা শারীরিকভাবে সুস্থ আছেন। তবে মানসিকভাবে ভেঙে পড়েছেন।
প্রসঙ্গত, বাংলাদেশ সফরে এসে ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট এমানুয়েল মাখোঁ এই রাহুল আনন্দের বাড়িতেই বেড়াতে গিয়েছিলেন। দেখে মুগ্ধতা প্রকাশ করেছিলেন রাহুলের তৈরি অদ্ভুত সব বাদ্যযন্ত্র। সেই যন্ত্রগুলোই হামলার শিকার হলো, শিক্ষার্থীদের বিজয়ের পর।
জলের গানের ফেসবুক পোস্টটি হুবুহ তুলে ধরা হলো-
“স্বপ্নে তুমি দাগ দিও না।
সরলরেখার স্বপ্নে কারো বাঁক দিওনা! বাঁক দিওনা!
জলের গানের ধানমণ্ডি ৩২ নম্বরের এই বাড়িটি শুধু রাহুল আনন্দের বসত বাড়ি ছিলোনা; ছিলো পুরো দলটির স্বপ্নধাম, আনন্দপুর। যেখানে তৈরি হয়েছে কত গান, কত সু্র, আর দাদার ভাবনা প্রসূত শত শত বাদ্যযন্ত্র। শুধু তাই নয়। জলের গানের অফিশিয়াল স্টুডিও হিসেবেও ব্যবহৃত হতো বাড়িটি। দলের সকলের দলগত সংগীত চর্চা থেকে শুরু করে, সকল স্টুডিও ওয়ার্ক – রেকর্ডিং, মিক্সিং, এডিটিং এখানেই হতো।
যারা নিয়মিত এই বাড়িতে যাতায়াত করতেন, তারা জানেন যে রাহুল আনন্দ ও উর্মিলা শুক্লার বাড়িটির সাদা গেটটি সবসময় খোলাই থাকতো। তাতে তালা দেয়া হতোনা। যে কেউ, যেকোনো দরকারে যেন দাদার কাছে পৌঁছোতে পারে সেই ভাবনায়। আর যারাই দিনের যেকোন প্রান্তে এই বাড়িতে এসেছেন, সকলেই একটি চিত্রের সাথে খুব পরিচিত, তা হলো- রাহুল আনন্দ মাটিতে বসে একটি সিরিশ কাগজ হাতে নিয়ে তাঁর নতুন বাদ্যযন্ত্রের কাঠ ঘষছেন।
জলের গানের বাদ্যযন্ত্র। রাহুল আনন্দের বিরাট ভাবনা ও স্বপ্নের দিকে ধাবমান এক নিরন্তর প্রয়াস। আমাদের দেশীয় কাঠে তৈরি, আমাদের নিজেদের বাদ্যযন্ত্র। শুধুই কি আমাদের? এই দলের? জলের গানের? না! এই প্রয়াস সকল নবীন মিউজিশিয়ানদের জন্য, যারা বিশ্বাস করবে – আমরাও আমাদের বাপ দাদার মতো নিজেদের বাদ্যযন্ত্র নিজেরাই তৈরি করে নিতে পারি! এই প্রয়াস সেই স্বকীয়তার; যার বলে এই দেশের মানুষ গর্বের সাথে বলতে পারে, এই আমাদের নিজেদের বাদ্যযন্ত্রে বেজে ওঠা অনন্য শব্দতরঙ্গ যা কিনা পুরো পৃথিবীর বুকে কেবল এই বাংলাদেশের মাটিতেই ঝনঝন করে বাজে, সুর তোলে, স্বপ্ন দেখায়। যেই স্বপ্নের ঝিলিক সুদূর ফ্রান্স থেকে আরেকজন মিউজিশিয়ানকে আমাদের দেশে টেনে আনে। পুরো পৃথিবীর লক্ষ কোটি মানুষের চোখের আলো পড়ে আমাদের এই দেশে। ধানমন্ডি ৩২ নম্বর রোডের এই বাড়িটিতে।
তবে কি এই ঠিকানায় আবাস হওয়াটাই কিছু মানুষের এত ক্ষোভের কারণ? এত রাগের বহিঃপ্রকাশ? যারা ইতিমধ্যে সেখানে গিয়েছেন কিংবা ফেসবুকে পোস্ট দেখেছেন তারা সকলেই খবরটি জানেন।
হ্যাঁ! – রাহুল আনন্দ ও উর্মিলা শুক্লার, এবং আমাদের সকলের প্রিয় জলের গানের এই বাড়িটি আর নেই। সব আগুনে পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। তবে সৃষ্টিকর্তার কৃপায় এবং আশীর্বাদে বাড়ির সকল সদস্য নিজের প্রাণ হাতে নিয়ে বেরিয়ে আসতে পেরেছেন এবং এখন নিরাপদে আছেন। কিন্তু, রাহুল দা এবং আমাদের দলের সকল বাদ্যযন্ত্র ,গানের নথিপত্র এবং অফিশিয়াল ডকুমেন্টস ছাড়াও, দাদার পরিবারের খাট-পালং, আলনা আর যাবতীয় সব পুড়ে ছাই হয়ে গেছে! সব! সকলের জন্য নিরন্তর ভেবে যাওয়া মানুষটিকে পরিবারসহ এক কাপড়ে তাঁর নিজ ঘর থেকে বের করে দেয়া হয়েছে। এর প্রভাব হয়তো আজীবন লালিত থাকবে তাঁর সন্তানের মনে; যার বয়স কিনা মাত্র ১৩ বছর – ভাবতেই কষ্ট হয়। এতদিন ধরে তিলতিল করে গড়ে তোলা স্বপ্ন সংসারের সবকিছু দাউদাউ করে জ্বলেছে চোখের সামনে। কিছু মানুষের ক্রোধ এবং প্রতিহিংসার আগুনে!
এই বাদ্যযন্ত্র, গান বা সাজানো সংসার হয়তো আমরা দীর্ঘ সময় নিয়ে আবার গড়ে নিতে পারবো। কিন্তু, এই ক্রোধ আর প্রতিহিংসার আগুনকে নেভাবো কিভাবে! কেন আমরা ভালবাসা আর প্রেম দিয়ে সবকিছু জয় করে নিতে পারি না? যেই স্বাধীনতার স্বপ্ন দেখি, সেই স্বাধীনতার রক্ষায় যদি একইভাবে এগিয়ে আসতে ব্যর্থ হই, তাহলে চরম নিরাশা, অপমান ও লজ্জায় নিজেদের গানই গেয়ে উঠি এক ভগ্ন হৃদয়ে-
‘কোন্ ছোবলে স্বপ্ন আমার হলো সাদা কালো?
আমার বসত অন্ধকারে; তোরা থাকিস ভালো!’
সকল প্রাণ ভালো থাকুক। নতুন আগামীর স্বপ্নকে আমরাও অভিবাদন জানাই একইভাবে। কিন্তু, নিজের উল্লাসের চিৎকার এবং সজোর হাততালিতে কারো স্বপ্ন ভেঙে না দেই!”
ফেসবুক পোস্টে ব্যান্ডটির একটি গানও আপলোড করা হয়েছে। এ প্রসঙ্গে পোস্টে বলা হয়েছে, “এই গানটি আমাদের এই ঘরে রেকর্ড করা শেষ গান। ভিডিওতে যা দেখছেন, তার কিছুই আর অবশিষ্ট নেই। উত্তাল সময়ের সাথে আমরাও একাত্ম ছিলাম গানে গানে। এই শেষ কাজটিই তবে সকলের জন্য আনন্দ উপহার।
জয়তু
জলের গান।”
উল্লেখ্য, প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগ করে সোমবার দেশ ছেড়েছেন আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা। টানা চারবার ক্ষমতায় আসার পরও ছাত্র আন্দোলনের মুখে পদত্যাগ করতে হয় তাকে।
প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে শেখ হাসিনার পদত্যাগ ও দেশ ছাড়ার খবরের দেশের বিভিন্ন জায়গায় থানা, সরকারি অফিস ভবন, আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের বাসভবন ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে অগ্নিসংযোগের খবর পাওয়া যাচ্ছে। এসব ঘটনায় মারা গেছেন বেশ পুলিশ সদস্যসহ বেশ কয়েকজন। নিহত হয়েছে আওয়ামী লীগের বেশ কয়েকজন নেতাকর্মী। বিভিন্ন স্থানে আটকও করা হয়েছে দলটির নেতাকর্মীদের।
পুলিশের ওপর হামলার ঘটনায় মঙ্গলবার থেকে অনির্দিষ্টকালের জন্য কর্মবিরতি ঘোষণা করেছে পুলিশ অধস্থন কর্মচারী সংগঠন।
এদিকে শেখ হাসিনার পদত্যাগের দ্রুতই অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠন করার কথা জানিয়েছেন সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান।
অন্যদিকে, বৈষ্যমবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়করা তাদের মতো করে অর্ন্তবর্তীকালীন সরকারের রুপরেখা তুলে ধরেছেন। যেখানে নোবেলজয়ী অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা করার দাবি জানিয়েছেন সমন্বয়করা।
আপনার মতামত লিখুন :