।।স্টাফ রিপোর্টার।।
প্রবল ঘূর্ণিঝড় রেমালের তাণ্ডবে লন্ডভন্ড হওয়া দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ১৯টি জেলায় সরকারের পক্ষ থেকে আরও ত্রাণ সহায়তা পাঠানো হয়েছে। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব কেএম আব্দুল ওয়াদুদ জানান, আগের বরাদ্দের সঙ্গে বুধবার নতুন করে ঘূর্ণিঝড় আক্তান্ত এলাকার ১৯ জেলায় এক কোটি ৯০ লাখ নগদ টাকা, শিশুখাদ্য কেনার জন্য ৯৫ লাখ টাকা এবং গোখাদ্য কেনার জন্য ৯৫ লাখসহ মোট তিন কোটি ৮০ লাখ টাকা অনুদান দেওয়া হয়েছে। আগামী ২ জুলাই আন্তঃমন্ত্রণালয় সভা শেষে ঝড়ে ক্ষতিগ্রস্ত ঘরবাড়ি মেরামতের জন্য ডেউটিন বরাদ্দ দেওয়া হবে।
এদিকে ক্ষতিগ্রস্ত অনেক এলাকায় এখনো কোনো ত্রাণসামগ্রী পৌঁছেনি। বিদ্যুৎ সরবরাহ পুরোপুরি স্বাভাবিক হয়নি। জলোচ্ছ্বাসে অনেক আঞ্চলিক সড়ক বিধ্বস্ত হওয়ায় যানবাহন চলাচল ব্যাহত হচ্ছে। পানিবন্দি হয়ে আছেন লাখ লাখ মানুষ। এরই মাঝে উপকূলে চলছে ঘুরে দাঁড়ানোর লড়াই। রেমালের তাণ্ডব সরেজমিন দেখতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বৃহস্পতিবার পটুয়াখালীর কলাপাড়া উপজেলায় গিয়েছিলেন। প্রধানমন্ত্রী এ সময় ঘূর্ণিঝড় দুর্গতদের মাঝে শুকনো খাবার ও ঢেউটিন বিতরণ করেন।
জানা গেছে, প্রধানমন্ত্রীর সফরের সময় বিতরণের জন্য শুধু পটুয়াখালীতে ২ হাজার প্যাকেট শুকনো খাবার এবং ৫০০ বান্ডিল ঢেউটিন বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। এ প্রসঙ্গে অতিরিক্ত সচিব কেএম আব্দুল ওয়াদুদ জানান, এটা সাধারণ বরাদ্দ নয়। এটা প্রধানমন্ত্রীর সফরের সময় বিতরণের জন্য বিশেষ বরাদ্দ।
ক্ষতিগ্রস্তদের অনুকূলে এর আগে ছয় কোটি ৮৫ লাখ টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে ১৫ জেলায় জিআর (ক্যাশ) তিন কোটি ৮৫ লাখ নগদ টাকা, পাঁচ হাজার ৫০০ টন চাল, পাঁচ হাজার প্যাকেট শুকনো খাবার, শিশুখাদ্য ক্রয়ের জন্য এক কোটি ৫০ লাখ, গোখাদ্য কেনার জন্য এক কোটি ৫০ লাখ টাকা প্রদান করা হয়েছে। ক্ষতিগ্রস্তদের পুনর্বাসন নিয়ে প্রতিমন্ত্রী বলেন, আমাদের বরাদ্দ অব্যাহত থাকবে।
রেমালের তাণ্ডবে মৎস্যচাষিরা পথে বসতে চলেছেন। দক্ষিণাঞ্চলের ১৯টি জেলায় প্রায় ৩৪ হাজার পুকুরে পানি ঢুকে ভেসে গেছে কোটি কোটি টাকার মাছ। ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে পুকুর ও ঘেরের পাড় এবং বেড়িবাঁধ। প্রায় ৪৯ হাজার ঘেরে পানি ঢুকে মৎস্যচাষিদের স্বপ্ন ভেসে গেছে। এছাড়া কাঁকড়া খামার ধ্বংস হয়েছে সাড়ে ৪ হাজারটি। ২০ হাজার ৫০০ মেট্রিক টন মাছ ভেসে গেছে। চিংড়ি ভেসে গেছে প্রায় সাড়ে ৭ হাজার মেট্রিক টন।
মৎস্য অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক আলোক কুমার সাহা বলেন, এগুলো একেবারেই প্রাথমিক তথ্য। প্রকৃত ক্ষয়ক্ষতি জানতে আরও সময় লাগবে।
তিনি জানান, মৎস্যচাষিদের ক্ষতি হয়েছে ৩৩০ কোটি টাকার। চিংড়িচাষিদের ক্ষতি হয়েছে ৩৩৯ কোটি টাকা। সার্বিকভাবে মৎস্য সেক্টরের প্রাথমিক ক্ষয়ক্ষতি প্রায় ৯৭৭ কোটি ৫২ লাখ ৭২ হাজার টাকা।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের ফিল্ড সার্ভিসের পরিচালক মো. তাজুল ইসলাম বলেন, এ পর্যন্ত ৪৮টি জেলা থেকে ক্ষয়ক্ষতির প্রাথমিক চিত্র পাওয়া গেছে। যাতে দেখা যায় প্রায় ১ লাখ ৫৩ হাজার ৬৩০ হেক্টর জমির ফসল সম্পূর্ণ ও আংশিক ক্ষতি হয়েছে। অনেক জেলায় এখনো বিদ্যুৎ সচল হয়নি। আমাদের মাঠ পর্যায়ের কৃষি কর্মকর্তারা কাজ করছেন। তবে যোগাযোগব্যবস্থা অর্থাৎ বিদ্যুৎ ব্যবস্থা স্বাভাবিক না হওয়া পর্যন্ত সব খবর পাওয়া যাবে না। আশা করি আগামী রোববার পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদন পাব।
বরিশাল, চট্টগ্রাম এবংখুলনার আঞ্চলিক ফুড অফিসাররা (আর সি-ফুড) জানান, তাদের অধিক্ষেত্রে কোনো খাদ্যগুদামের ক্ষতি হয়নি। শুধু বরিশালের আরসি ফুড জানান, ভোলা ও গলাচিপায় গাছ পড়ে খাদ্যগুদামের দেওয়াল বিনষ্ট হয়েছে। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের সূত্রমতে, বেশি ক্ষতিগ্রস্ত ১৯টি জেলা হলো- বরিশাল, খুলনা, সাতক্ষীরা, বাগেরহাট, ঝালকাঠি, পটুয়াখালী, পিরোজপুর, বরগুনা, ভোলা, ফেনী, কক্সবাজার, চট্টগ্রাম, নোয়াখালী, লক্ষ্মীপুর, চাঁদপুর, নড়াইল, গোপালগঞ্জ, শরীয়তপুর ও যশোর।
বরিশাল : ঘূর্ণিঝড় রেমালের প্রভাবে বরিশাল জেলায় ৬ হাজার ৪৪১ হেক্টর জমির ফসল ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এর মধ্যে শতভাগ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ২ হাজার ৮৫ হেক্টর জমির ফসল। প্রাথমিক হিসাব অনুযায়ী আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ ১১০ কোটি টাকা। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের বরিশাল জেলার উপপরিচালক মুরাদুল হাসান এই তথ্য নিশ্চিত করেছেন। এসব ফসলের মধ্যে রয়েছে আউশ, পান, শাকসবজি, পেঁপে এবং কলা। বরিশাল বিভাগের ৬ জেলায় ১ লাখ ৮০ হাজার ৪৮১ কৃষক পরিবার ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
কাঁঠালিয়া (ঝালকাঠি) : ঝালকাঠির কাঁঠালিয়া উপজেলায় প্রায় ৩০০ কোটি টাকার ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। কাঁচা-পাকা রাস্তা ভেঙে যাওয়ায় অনেক এলাকায় যোগাযোগব্যবস্থা এখনো বিচ্ছিন্ন রয়েছে। শত শত একর জমির ফসল ও রোপা আউশ পানিতে ডুবে থাকার কারণে পচে যাচ্ছে। ৯ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ ও রাস্তা ভেঙে যাওয়ায় আতঙ্কে রয়েছেন এখানকার মানুষ।
ভোলা : ভোলায় রেমালের তাণ্ডবে গাছ পড়ে আহত আরও একজনের মৃত্যু হয়েছে। এ নিয়ে সরকারি ঘোষণা অনুযায়ী এ জেলায় মারা গেছেন ৪ জন। মঙ্গলবার বিকালে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সজল চন্দ শীল ভেদুরিয়া ইউনিয়নে নিহত ফারিক ফরাজীর স্ত্রী ও স্বজনদের সান্ত্বনা দেন। এ সময় নগদ অর্থ ও দুই বস্তা চাল দেন তিনি। বুধবার ক্ষতিগ্রস্তদের মাঝে ত্রাণসামগ্রী বিতরণ করা হয়। জেলা প্রশাসক আরিফুজ্জামান জানান, জেলায় ক্ষতিগ্রস্ত ৩ হাজার পরিবারের জন্য ৩৫০ মেট্রিক টন চাল ও ১৭ লাখ টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। জেলার ৭ উপজেলায় ত্রাণসামগ্রী বিতরণ শুরু হয়েছে। এলজিইডির নির্বাহী প্রকৌশলী ইব্রাহিম খলিল জানান, ঝড়ের সময় জলোচ্ছ্বাসে তার দপ্তরের নির্মিত ২৫৬ কিলোমিটার সড়ক ধসে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
পটুয়াখালী : পটুয়াখালীতে ৪০ হাজার ঘরবাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এর মধ্যে ৬ হাজারের বেশি ঘর সম্পূর্ণ বিধ্বস্ত হয়েছে বলে জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন বিভাগ সূত্রে জানা গেছে। বুধবার বেলা ১১টা পর্যন্ত সদর উপজেলার ভাজন আশ্রয়কেন্দ্রে লোকজনের উপস্থিতি লক্ষ করা গেছে। জেলার অনেক এলাকায়ই এখনো পৌঁছেনি সরকারি ত্রাণ সহায়তা। জেলায় ৩ লাখ ৩৮ হাজার মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মকর্তা সুমন দেবনাথ জানিয়েছেন, জেলায় ৩৫০ মেট্রিক টন জিআর চাল ও ২১ লাখ ৭৫ হাজার টাকার ত্রাণসামগ্রী বিভিন্ন ক্ষতিগ্রস্ত এলাকায় পাঠানো হয়েছে। তবে পটুয়াখালী সদর উপজেলার পায়রা পাড়ের তুষখালী, ভাজনা, ভুতুমিয়া ও ফুলতলা গ্রামের প্রায় দেড় হাজারের মতো মানুষ ঘরবাড়ি হারিয়ে মানবেতর জীবনযাপন করলেও মঙ্গলবার রাত পর্যন্ত সরকারিভাবে কোনো ত্রাণ সহায়তা পৌঁছেনি বলে জানান আশ্রয়কেন্দ্রে আসা লোকজন।
বাউফল (পটুয়াখালী) : বাউফলে রেমালের তাণ্ডবে ক্ষতিগ্রস্তদের মাঝে ত্রাণসামগ্রী বিতরণ করা হয়েছে। বুধবার উপজেলার চন্দ্রদ্বীপ, নাজিরপুর, কেশবপুর, ধুলিয়া, কালাইয়া ও কালিশুরী ইউনিয়নসহ দুর্গত এলাকা পরিদর্শন করেন দুর্যোগ ও ত্রাণ মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি আসম ফিরোজ এমপি। এ সময় তিনি ক্ষতিগ্রস্তদের মাঝে ত্রাণসামগ্রী এবং প্রায় ২৫০ বান্ডেল ঢেউটিন বিতরণ করেন। চাহিদার তুলনায় ত্রাণসামগ্রী কম হওয়ায় অনেকে হতাশ হয়ে বাড়ি ফিরে যান। জানা গেছে, ঘূর্ণিঝড়ের আঘাতে উপজেলার লক্ষাধিক পরিবার ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন।
নাজিরপুর (পিরোজপুর) : নাজিরপুরে প্রায় ৬০ কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে। সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয়েছে মৎস্য ও পোলট্রি খাতে। সংশ্লিষ্ট প্রশাসনিক সূত্র জানায়, উপজেলার ৯টি ইউনিয়নের ১২শ মাছের ঘের ও সাড়ে ৪ হাজার পুকুর প্লাবিত হয়েছে। এতে প্রায় ২১ কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে। আসন্ন কুরবানি ঈদ উপলক্ষ্যে স্থানীয় খামারিদের পালন করা ১২ হাজার ১০৩টি গরু, ১০ হাজার ১৭৭টি ছাগল ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এছাড়া ১ লাখ ৮০ হাজার মুরগি আক্রান্ত হয়েছে। ৩৫ হাজার ১৭৭টি মুরগি, ২ হাজার হাঁস ও কিছু গরু-ছাগল মারা গেছে। এসব মিলিয়ে প্রায় দেড় কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে। উপজেলায় ৩ হাজার ২০২ হেক্টর জমির ফসল নষ্ট হয়েছে। যার আনুমানিক মূল্য প্রায় ১০ কোটি টাকা।
এ ছাড়া রেমালের তাণ্ডবে বরগুনার আমতলী উপজেলায় ১১০টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
আপনার মতামত লিখুন :